প্রথম সন্তানের আগমন নিয়ে কতই না শিহরিত ছিল ইতি! কত আনন্দ! কত পরিকল্পনা!! কত স্বপ্নের জাল বোনা!!! আর সন্তান জন্মের পর? বাড়ি জুড়ে আত্মীয়-পরিজনের উৎসবের মাঝেই কেমন যেন বিষাদমাখা ইতির ভূবন!
কেন এই বিষাদ? কেন এই মন খারাপ অস্বস্তিকর অনুভূতি?
নিজের ভেতর কোনো উত্তর পায় না সে। মনের আকাশজুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা সারাক্ষণ। সবার আড়ালে সে মেঘ কখনও কখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরে ইতির দৃষ্টি পথে। মুখ ফুটে কাউকে বলা যায় না অন্তর্গত অস্বস্তির কথা! কী মনে করবে সবাই? এই ভাবনা কণ্ঠ চেপে ধরে তার।
সপ্তাহ খানেকের মাঝে ইতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও সিঁথির সমস্যাটা রয়েই যায়। প্রথম সন্তান জন্মের পর তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পরও প্রথম একমাস ভালোই ছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে মনটায় বিষণ্ণতা ভর করে।
নিদ্রাহীন রাতের পর রাত, খাবারে ব্যাখ্যাহীন অরুচি, সকল কাজে অকারণে অনাগ্রহ- সবমিলে বিধ্বস্ত লাগে। কেউ হয়তো তার পরিবর্তনটা লক্ষ্য করে না, করলেও তেমন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। অবশেষে সবার টনক নড়ে সেদিন; যেদিন শয্যায় অচেতন পড়ে থাকা সিঁথির বালিশের কাছে ঘুমের ওষুধের চারটি খালি পাতা পাওয়া যায়।
রূপার সমস্যাটা দেখা দেয় অন্যরূপে। প্রথম সন্তান জন্মের পরের সপ্তাহ দুয়েক ভালো ছিল সেও। এর পরপরই স্বামী আর নিকটাত্মীয়রা ওর মাঝে আচরণ, কথাবার্তায় দেখতে পায় অস্বাভাবিকতা।
কেমন যেন এলোমেলো কথা বলতে শুরু করে রূপা। নিজের সন্তানের প্রতি কোনো খেয়াল থাকে না। তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, যত্ন নেয়ার কথা যেন মনেই থাকে না। কেউ মনে করে দিলে অদ্ভুত ঔদাসীন্যে এড়িয়ে যায়।
কখনও কখনও বলে- ওটা তার সন্তান নয়, ওটা একটা ডাইনি, অশুভ প্রেতাত্মা। তার প্রবল কোনো ক্ষতির উদ্দেশ্য নিয়ে এ ঘরে ঢুকেছে ওটা। রাত-বিরাত নেই, ছুটে-ছুটে ঘরের বাইরে চলে যায় রূপা। কে যেন তাকে ডাকে বাইরে থেকে। কেউ শোনে না, শুধু রূপার কানেই বাজে সে ডাক।
দাদী-শ্বাশুড়ি বলেন, পিশাচ বা ডাইনি ভর করেছে রূপার উপর। ‘অশুভ আত্মা’র প্রভাব কাটাতে ডাকা হয় কবিরাজ-ওঝা-বৈদ্য। চলে ঝাড়-ফুঁক, তেলপড়া আর কড়ি চালান।
সন্তানের জন্ম পরিবারে নিয়ে আসে আনন্দের উপলক্ষ্য। মাতৃত্বের গর্ব নারীকে দেয় পরিপূর্ণ নারীত্বের অনুভূতি। তবে উল্লেখিত ঘটনাগুলো ইতি, সিঁথি আর রূপার মতো সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া প্রসূতির মাঝে নানা নেতিবাচক অনুভূতি ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।
প্রসব ও প্রসব-প্ররবর্তী সময়ে নারীদেহে হরমোনের বিশেষতঃ ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের তারতম্য, প্রসবজনিত মানসিক চাপ, নতুন দায়িত্বের নেতিবাচক উপলব্ধি-সব মিলিয়েই নারীর মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পোস্ট পার্টাম বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীদের যেসব মানসিক সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো প্রধানত তিন ধরণের- পোস্ট পার্টাম ব্লু, পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন এবং পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিস।
পোস্ট পার্টাম ব্লু
প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রসূতি প্রসবের চার থেকে ছয় সপ্তাহের ভেতর আবেগজনিত সমস্যায় ভোগেন। নতুন মা অস্থিরতাবোধ করেন, ক্ষণেই মন খারাপ হয়ে যায়, কান্না পায়, ক্ষণে উদ্বেগ আর খিটখিটে বিরক্তি অনুভব করেন। সবকিছু বিশৃঙ্খল-এলোমেলো মনে হয়। প্রসব-পরবর্তী সাময়িক এই মানসিক অবস্থাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়- ‘বেবি-ব্লু, ম্যাটারনিটি ব্লু বা পোস্ট-পার্টাম ব্লু’। প্রসবের তিন থেকে পাঁচ দিনের ভেতরেই সাধারণত এসব লক্ষণ দেখা যায়। কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত এই লক্ষণগুলো স্থায়ী হতে পারে। আক্রান্ত নারীরা অনেক সময় প্রসবের আগেই গর্ভধারণের শেষ মাসগুলোতে উদ্বেগ ও মন খারাপভাব অনুভব করেন।
প্রথম গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সাধারণত এই সমস্যাটি বেশী দেখা যায়। কিছুদিন পর আপনা-আপনি এই সমস্যা কেটে যায় বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
তবে এসময়ে নিকটজনের সমর্থন, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রয়োজন অপরিহার্য। পরিবারের বিশেষ করে স্বামীর রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। নতুন মায়েরও উচিত মনের দুঃখবোধ চাপা না রেখে স্বামী বা প্রিয় কারও সাথে অনুভূতি প্রকাশ করা এবং সহযোগিতা কামনা করা।
এছাড়াও ‘ব্লু’-তে আক্রান্ত নতুন মায়ের জন্য প্রয়োজন সন্তান প্রতিপালন ও দৃঢ়তার সাথে মানসিক চাপ মোকাবেলার শিক্ষা।
পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন
১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসূতি আক্রান্ত হতে পারেন ‘পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন’ বা প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায়। ‘বেবি ব্লু’র মতো ক্ষণস্থায়ী নয় এ রোগ। উপসর্গগুলোও হয় তীব্র। প্রায় সকল সময় বিষণ্ণতা, হতাশা, অতিরিক্ত উদ্বেগ, অনিদ্রায় ভোগেন নতুন মা। দৈনন্দিন কাজকর্মে উৎসাহ থাকে না। এমনকি নিজের শখের বা পছন্দের কাজগুলো করতেও আর ভালো লাগে না।
অল্প পরিশ্রম বা বিনা পরিশ্রমেই ক্লান্তিবোধ করেন। অধিকাংশের খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায়। স্বল্পাহার বা অনাহারে থাকার ফলে কিছুদিনের মধ্যে উলেখযোগ্য হারে ওজনও কমে যায় অনেকের। অনেকেই অকারণে অপরাধবোধে ভোগেন, বিগত দিনের তুচ্ছ ঘটনাকে নতুন ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করার ফলে নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। উপসর্গগুলো দুই সপ্তাহের বেশি সময় স্থায়ী হয়। ধীরে ধীরে পরিবারের সকলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে খোলসমন্দি হয়ে পড়েন নারী।
মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় ব্যক্তিজীবন অথবা সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্ক। কেউ কেউ নিজের জীবন সম্পর্কে একসময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
বিষণ্ণতায় আক্রান্ত নারী সন্তানের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। মায়ের বিষণ্ণতার কারণে সন্তান উপযুক্ত মাতৃস্নেহ ও সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। পরবর্তীতে তা সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমনি সন্তানের প্রাথমিক আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধিও বাঁধাগ্রস্ত হয়।
প্রসবের ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নারী আক্রান্ত হতে পারেন বিষণ্ণতায়। যাদের প্রসব-পূর্ববর্তী সময়েও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার অথবা রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়ের গুরুতর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাদের ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া মানসিক চাপ, সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে অত্যধিক পরিশ্রম ও অনিদ্রা, বিশৃঙ্খল দাম্পত্য সম্পর্ক, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, সহায়ক পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনের অভাব এই ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে মাস থেকে বছরব্যাপী এই রোগ স্থায়ী হতে পারে। এদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে গুরুতর বিষণ্ণতায় পুণরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপী ও সামাজিক সহায়তার গুরুত্ব রয়েছে।
পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিস
এটি প্রসবোত্তর জটিল মানসিক সমস্যা। একে ‘পিউয়েরপেরাল সাইকোসিস’ও বলা হয়। প্রতি হাজার শিশু-জন্মের মধ্যে ১ বা ২ জন প্রসূতি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। রোগী ক্লান্তি, নিদ্রাহীনতা এবং অস্থিরতাবোধ করেন। কারও মাঝে আবার আবেগ নিয়ন্ত্রণে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে অহেতুক সন্দেহ, ভ্রান্ত বিশ্বাস, অতিরিক্ত এবং আবোল-তাবোল কথা বলা, অসংলগ্ন, অস্বাভাবিক আচরণ, খাওয়া ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদাসীনতা, খিটখিটে মেজাজ, সন্তানের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ অথবা অমনোযোগিতা ও অযত্ন-অবহেলা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। রোগীর ভ্রান্ত বিশ্বাস অনেক সময় এই পর্যায়ে চলে যায় যে, তিনি মনে করেন, তার সন্তানটি অশুভ কিছু, একে হত্যা করা উচিত।
অনেকে সন্তানের জন্মদানকেই অস্বীকার করেন; নিজেকে অবিবাহিত, নিগৃহীত বা নির্যাতিত বলে দাবী করেন। অনেকে গায়েবি আওয়াজ শুনতে পান। শুনতে পান কোনো কণ্ঠস্বর আদেশ দিচ্ছে তাকে অথবা তার সন্তানকে হত্যা করতে। কিছুক্ষেত্রে রোগের মারাত্মক পর্যায়ে রোগী তার সন্তানের ক্ষতি করেন এমনকি মেরেও ফেলেন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ৫ শতাংশ নারী আত্মহত্যা করেন এবং ৪ শতাংশ নিজ সন্তানকে হত্যা করেন।
সাধারণত প্রসবের দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা দিলেও কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রসবের দু-এক দিনের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। কারও কারও উপসর্গ দেখা দিতে আরও একটু দেরি হলেও প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রসবের আটসপ্তাহ পার হওয়ার আগেই উপসর্গ দেখা দেয়।
প্রথম গর্ভধারণ এবং অবিবাহিত মায়েদের ক্ষেত্রে এ রোগের ঝুঁকি বেশি। এছাড়া যেসব প্রসূতির নিজেদের অথবা পরিবারের কারও জটিল মানসিক রোগের ইতিহাস আছে, তারাও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। একবার এ রোগে আক্রান্ত হলে পরবর্তী গর্ভধারণে এ রোগে আবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ, লিথিয়াম এবং কখনও কখনও এর সাথে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সহযোগে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে ইলেকট্রো-কনভালসিভ থেরাপী বা ইসিটি প্রয়োজন হয়।
রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রাখার প্রয়োজন হতে পারে। যদি প্রসূতি চান, তবে সন্তানকে তার সাথে রাখা উপকারী। তবে, মা ও শিশু উভয়কে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে বিশেষত মা-কর্তৃক যদি শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রোগের তীব্র অবস্থা বা ‘একিউট সাইকোসিস’ সময়টুকু কেটে গেলে সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে।
সাইকোথেরাপির মাধ্যমে সাধারণত প্রসূতিকে তার মাতৃত্বের ভূমিকায় সহজ হতে ও মানিয়ে নিতে সহায়তা করা হয়। এছাড়াও স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতাও এই সময় একান্ত প্রয়োজনীয়।
পোস্ট পার্টম সাইকোসিসে আক্রান্ত নারীর অধিকাংশই সঠিক চিকিৎসায় স্বাভাবিক, সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তাই প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীর মাঝে অস্বাভাবিক লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিলে ঝাড়-ফুঁক, ওঝা-কবিরাজ দিয়ে অপচিকিৎসা না করিয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন।
0 Comments